মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেলেন ১০৮ শব্দসৈনিক

প্রকাশিত: ৯:০৫ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৬, ২০১৬

মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেলেন ১০৮ শব্দসৈনিক

নিউ সিলেট ডেস্ক :::::   তারাও মুক্তিযোদ্ধা। তবে অস্ত্র হাতে নয়, তারা লড়াই করেছেন সুরে সুরে, শব্দের ঝংকারে। তারা উব্দুদ্ধ রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের। তারা হলেন মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর এবার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন তারা।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ১০৮ জন শিল্পীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আজ বুধবার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে এখনও বাদ পড়ে গেছেন কেউ কেউ।
যাদের নামে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে তাদের মধ্যে ৫০ জনই মৃত। আর ১৮ জন নারী।
মুক্তিযোদ্ধার স্বীকিৃতি পাওয়া সবচেয়ে বেশি ২৭ জন শিল্পী ঢাকা জেলার বাসিন্দা। এ ছাড়া কুমিল্লার ১২ জন, চট্টগ্রামের ১০ জন, মুন্সিগঞ্জের ছয় জন, কুষ্টিয়া ও সিরাজগঞ্জের পাঁচ জন করে, সিলেট ও রাজশাহীতে চার জন করে, মাদারীপুর, বরিশাল, গাইবান্ধার তিন জন করে, ফেনী, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা ও নীলফামারীর দুই জন করে এবং নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, ভোলা, বরগুনা, যশোর, মেহেরপুর, রংপুর, নাটোর, পাবনা একজন করে স্বীকৃতি পেয়েছেন।বর্তমান সরকার রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি নির্যাতনের শিকার নারীদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বীরাঙ্গনারাও এখন মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। এখন আসলো শব্দসৈনিকদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত।
মুক্তিযু্দ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা বর্ণনা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বেতারকেন্দ্রের কর্মীরা যে ভূমিকা রেখেছিলেন তা নিঃসন্দেহে দেশ স্বাধীন হওয়ার ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছে। তাদের এই স্বীকৃতি প্রাপ্য। আমি শুনে অনেক খুশি হয়েছি।’
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, অনেক দিন পরে হলেও আমরা এই কাজটি করতে পেরেছি। তাদের একটি পাওনা ছিল। আরও অনেক আগেই এই কাজটি করে ফেলা উচিত ছিল।
মন্ত্রী জানান, সাংবাদিক কামাল লোহানীসহ সেই সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মীরাই এই তালিকা দিয়েছেন। সে অনুযায়ী তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর পরও যদি কারও নাম বাদ যায়, তাহলে সেটাও অন্তর্ভূক্ত করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী জানান, মুক্তিযোদ্ধারা যে ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা পান, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী অথবা তাদের উত্তরাধিকাররাও এখন থেকে সে সুযোগ সুবিধা পাবেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও রণাঙ্গনের সংবাদদাতা হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক মুসা সাদিক  বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা পঙ্গুপালের মতো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। এর পেছনে বড় অবদান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মীদেরকে। এই কর্মীদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া ন্যায্য অধিকার। দীর্ঘদিন পরে হলেও সরকার এই স্বীকৃতি দিয়েছে। এ জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই।
মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর পরে হলেও এই স্বীকৃতি দেওয়ায় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বুলবুল মহলানবীশ। তিনি বলেন, আমরা অনেক দিন ধরেই স্বীকৃতির জন্য দাবি জানিয়ে আসছিলাম। সে সময় সশস্ত্র যোদ্ধাদের মতো জীবন বাজি রেখেই আমাদেরকে গান গাইতে হয়েছে।
এই শিল্পী বলেন, আমরা কেবল গান গাইনি, সে সময় টাকাও তুলেছি। এই টাকা মুক্তিযোদ্ধাদের তহবিলে জমা দেওয়া হয়েছে। এখন দেরিতে হলেও আমাদের ভূমিকার স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা আনন্দিত।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মী কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন, আগে আমাদেরকে বলা হতো শব্দ সৈনিক। এখন আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেলাম। আজ আমাদের মধ্যে অনেকেই আর পৃথিবীতে নেই। তারা বেঁচে থাকলে নিশ্চয় এই স্বীকৃতিতে অনেক বেশি খুশি হতেন।
জনাব গুণ বলেন, সশস্ত্র যুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছেন, আমরা ঠিক তাদের মতো নই। কিন্ত আমাদেরও চেষ্টা ছিল কীভাবে দেশকে স্বাধীন করা যায়। পত্রপত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনে সারা পৃথিবীতে স্বাধীন বাংলাদেশের বার্তা পৌঁছে দিতে আমরা মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করেছি। অনেক দিন পরে হলেও এই স্বীকৃতি পাওয়ায় শান্তি পাচ্ছি।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিহাস
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চ লাইটের নামে বাঙালি হত্যা শুরুর পর থেকেই রুখে দাঁড়ায় স্বাধীনতাকামী মানুষ। ওই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক দেয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তার আগেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তার বার্তাটি ঢাকা ইপিআর ওয়ারলেস স্টেশান থেকে সিলিমপুর ওয়ারলেস স্টেশানের ইঞ্জিনিয়ার গোলাম রব্বানী ডাকুয়ার হাত দিয়ে চট্টগ্রামে পৌঁছে যায়। তার পরেই পাকিস্তানীরা ইপিআর ওয়ারলেস ধ্বংস করে দেয়।
চট্টগ্রামের অনেক জায়গায় মধ্য রাত থেকেই মাইকে বার্তাটি প্রচার করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে পরদিন ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিশান কেন্দ্র হতে প্রথমবারের মত স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ঐ বার্তা পাঠ করেন।
এর মধ্যেই বেলাল মোহাম্মদ এবং আবুল কাশেম সন্দ্বীপসহ তৎকালীন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন বেতারকর্মী বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনগণকে সচেতন ও উব্দুদ্ধ করতে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র নামে একটি প্রচার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। নিরাপত্তার কারণে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রকে কাজে না-লাগিয়ে শহর থেকে কিছু দূরে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে চলে যান তারা।
২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে প্রথম প্রচার করেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। সে সময়েই এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি আবার পাঠ করেন। প্রায় এক ঘণ্টা অনুষ্ঠান প্রচার করেন তারা।
পরদিন এই বেতার কেন্দ্র থেকেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন সে সময়ের মেজ জিয়াউর রহমান। এরও পরদিন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র নাম থেকে বিপ্লবী শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। ওই দিন প্রথম অধিবেশনে বিমান হামলায় করণীয় সম্পর্কে নির্দেশমালা প্রচারিত হয় এবং দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রথম একটি কথিকা পাঠ করা হয়।
৩০ মার্চ দুপুরের দিকে বেতার কেন্দ্রে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বিমান হামলা করলে এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠাতা দশজন সদস্য দুটি দলে বিভক্ত হয়ে আগরতলা ও ত্রিপুরার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন।
এরপর নানা ঘটনাপ্রবাহের পর ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে প্রচার হতে থাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচার। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে এই বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
যারা স্বীকৃতি পেলেন
ঢাকা জেলা: মৃত সমর দাস, বুলবুল মহলানবীশ, তরুণ কুমার মহলানবীশ, শক্তি মহলানবীশ, ডালিয়া নওশিন, লাকী আকন্দ, মঞ্জুলা দাস গুপ্তা, মৃত অমিতাভ সেনগুপ্ত, মো. কামালউদ্দিন আহমেদ, শারমীন সোনিয়া মুরশীদ, তাজিন মাহনাজ ‍মুরশীদ, মৃত সৈয়দ মোহাম্মদ চাঁন, শীলা ভদ্র, আবদুল্লাহ আল ফারুক, শিপ্রা রায়, মামুনুর রশিদ, মোতাহার হোসেন, নাসিমুল কাদের চৌধুরী, শাহীদ সামাদ, মৃত আবদুল জব্বার খান, রূপা খান (রূপা ফরহাদ) মোজাফফর হায়াত খাত, জাহাঙ্গীর হায়াত খান (রুমু খান), বুলবন ওসমান, ছন্দা ভুঁইয়া জাহরা, মৃত নিতাই চন্দ্র সরকার, মৃত শওকত ওসমান।
মাদারীপুর জেলা: মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন খান, আমির হোসেন ও মঞ্জুর আহমেদ।
শরীয়তপুর: মৃত আবদুল হালিম মিয়া।
রাজবাড়ী: মৃত গোপী বল্লভ।
মুন্সিগঞ্জ: আশফাকুর রহমান খান, শেখ নাসিরউদ্দিন, বাবুল দত্ত, মৃত সরদার আলাউদ্দিন, মৃত এ বি এম মঞ্জুর কাদের (বাবুল আক্তার) এবং মৃত নঈম গওহর।
গোপালগঞ্জ: অনিল কুমার দে ও শহীদ হাসান।
নারায়ণগঞ্জ: মৃত তোফাজ্জল হোসেন শিকদার (টিএইচ শিকদার)।
গাজীপুর: মৃত নিখিল দেব।
নরসিংদী: মৃত মৃন্ময় দাসগুপ্ত।
কিশোরগঞ্জ: মৃত বিপুল ভট্টাচার্য ও মৃত জাহিদ সিদ্দিকী।
কুমিল্লা: মোহাম্মদ ফারুক, মৃত বাদল রহমান, মৃত কাজী হাবিব উদ্দিন আহমেদ মনি, মৃত সৈয়দ আব্দুস শাকের, মো. ফেরদৌস হোসেন ভুঁইয়া ও মোমিনুল হক চৌধুরী।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া: মৃত রাশিদুল হোসেন, সৈয়দ মহিউদ্দিন হায়দার খোকা, আলী জাকের, শেখ সাদী খান, মৃত তানসেন খান ও মৃত তড়িৎ হোসেন খান।
ফেনী: মৃত আ ন ম গাজীউল হক ও মৃত জহির রায়হান।
চট্টগ্রাম: মৃত বেলাল মোহাম্মদ, সুব্রত বিকাশ বড়ুয়া, সখিনা বেগম, জয়ন্তী ভুঁইয়া, অজয় কিশোর হোড়, দেব চৌধুরী, মৃত আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, মৃত শেফালী ঘোষ, মৃত ননী গোপাল দত্ত ও মিহির লালা।
ভোলা: মৃত শহীদুল ইসলাম।
বরিশাল: অরুণা রাণী সাহা, আসাদ চৌধুরী ও মৃত আলমগীর কবীর।
বরগুনা: অরূপ তালুকদার।
সিলেট: সুজেয় শ্যাম, নাসরিন আহমেদ (জেরিন আহমেদ), অনুপম কুমার ভট্টাচার্য ও মাওলানা শেখ মো. উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী।
বাগেরহাট: সৈয়দ হাসান ইমাম ও লালয়া হাসান।
সাতক্ষীরা: আবু তোয়াব খান ও কাজী রোজী।
যশোর: মৃত মুস্তফা আনোয়ার হোসেন খান।
মেহেরপুর: মৃত শেখ জমিরউদ্দিন।
কুষ্টিয়া: মোহসীন রেজা, মৃত খন্দকার আমিনুল হক বাদশাহ, মৃত খন্দকার এমদাদুল হক (মান্না হক), এম এ মান্নান ও হালিমা জব্বার।
গাইবান্ধা: আশরাফুল আলম মোহাম্মদ রেজাউল করিম চৌধুরী ও মৃত টিপু চৌধুরী।
রংপুর: মৃত অজিত রায়।
নীলফামারী: মৃত হরলাল রায় ও রথীন্দ্র নাথ রায়।
নাটোর: আখতার হোসেন।
রাজশাহী: মৃত গোলাম রাব্বানী, কাজী মিসবাহুন নাহার, মো. রেজাউল করিম (রবু) ও মো. রফিকুল আলম।
সিরাজগঞ্জ: কামাল লোহানী, মাজহারুল ইসলাম, মহাদেব সাহা, মৃত গাজী শাহ আলী সরকার ও মৃত ড. মাজহারুল ইসলাম।
পাবনা: কাদেরী কিবরিয়া।
নেত্রকোণা: মাহবুব তালুকদার ও নির্মলেন্দু গুণ।

16/11/16-DT/NS/-



This post has been seen 254 times.

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ শিরোনাম

অনুসন্ধান ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১